আন্দোলনের সময়কাল ধারাবাহিকতা নিচে উল্লেখ করা হলো;
১৯৪৭ সালে জিন্নাহ সাহেবের দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে তথাকথিত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দিনে একি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা হয়। কিন্তু দুইটি দেশের মধ্যে ধর্ম ব্যতীত যার ভৌগোলিক অবস্থান, ভাষা, সাহিত্য ও সৃংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল অনেক ব্যবধান। শক্তিশালী পাকিস্তানি রাষ্ট্রগঠনে উভয় অঞ্চলের জনস্বার্থে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়োজন ছিল।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানি শাসকচক্র বাংলাদেশকে শোষণ এবং শাসন করেছে। অত্যাচার, নির্যাতন আর বঞ্চনার ইতিহাস। তবে বাঙালিরা এই অত্যাচার, নির্যাতনকে মুখ বুজে সহ্য করে নি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রক্ষিত
পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে শাসকশ্রেণির বাঙালি নির্যাতনের ইতিহাস নতুন কোনো ঘটনা নয়৷ ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সালের ইতিহাস বাঙালিদের চরম হতাশা এবং বঞ্চনারই ইতিহাস। শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতীয় সত্তাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য বাঙালিদের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়।
তারা প্রথম ষড়যন্ত্র শুরু করে রাষ্ট্র ভাষা ও সংস্কৃতি কি হবে এই নিয়ে। পাকিস্তানের রষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃবর্গের মধ্যে জল্পনা - কল্পনা শুরু হয়। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং কতিপয় মুসলিম বুদ্ধিজীবী একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার মত প্রকাশ করেন। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষের মুখে বাংলা ভাষা এবং শতকরা ৮ ভাগ লোকের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বাঙালি জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
ভাষা আন্দোলনে পূর্ব বাংলার গণপরিষদ ( ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত)
পাকিস্তান জন্মের টর থেকেই ঢাকার ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী মহল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তীব্র প্রতিবাদ শুরু করলো। এতদসত্ত্বে সরকার নির্দেশে অফিস আদালত ইংরেজি ও উর্দু ভাষা প্রচলন করে।
পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজের আন্দোলনের মুখে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত হয় ৩ সদস্যবিশিষ্ট্র “তমুদ্দুন মজলিস”। এ সময় তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করে।
এরপরই গঠিত হয়েছিল গণতান্ত্রিক যুবলীগ। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো দাবি উত্থাপন করে ১৯৪৭ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. এনামুল হক প্রমুখ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে ইসলামি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক দাবি করে বলেন যে “ একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। যাঁরা এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন তাঁরা পাকিস্তানের শত্রু।”
১৯৪৮ সালের ২৫ ফ্রেব্রুয়ারি গণপরিষদের আদিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসাবে ব্যবহারের প্রস্তাব করেন কুমিল্লা থেকে নিধর্রিত প্রথম গণপরিষদ সদস্য বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি জানান। তবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বিরোধিতাজন্য এ প্রস্তাব কার্যকর হয় নি। এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র - শিক্ষক ও অন্য বুদ্ধিজীবীরা সংগ্রম পরিষদ গঠন করেন। এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সমগ্র (বর্তমান) বাংলাদেশে ধর্মঘাট পালিত করেন।
এরূপ উত্তপ্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পাকিস্তানি শাসকচক্র এবং বাঙালিদের মধ্যে যখন দরকষাকষি চলছল সেই মুহূর্তে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দানকালে আনুষ্ঠানিক ভাবে একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ( একুশে ফেব্রুয়ারির রাজপথ)
বাঙালিদের জাতীয় জীবনে এক স্মরণীয় দিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। পূর্ব বাংলার অকুতোভয় সংগ্রামী জনগণ ও ছাত্র সমাজ সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শোভাযাত্রাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো কলাভবনে প্রঙ্গণে মিলিত হয়। সেখানে ছাত্র নেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্র নেতা আবদুল মতিনের প্রস্তাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
অবশেষে সরকার অবস্থা বেগতিক দেখে জনগণের চাপের মুখে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
খুব দূরত্ব দ্বিতীয় পাট আছে.... ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস কি?